সুভাষ চৌধুরী
এ লেখায় হাত দিতেই এক শুভাকাঙ্ক্ষী ফোন করে বললেন, আজ দুই বস্তা ধান বিক্রি করেছি ১৬ শ’ টাকায়। অথচ এই দুই বস্তা ধান উৎপাদনে আমার ব্যয় হয়েছে গড় পড়তা দুই হাজার টাকার কম নয়। এই ধান কাটা শুকানো পর্যন্ত যেতে জোন মজুরি গেছে এক হাজার টাকার কম নয়। এরপর বাজারে আনতে খরচ কতো। তাহলে কি দাঁড়ালো। এক বাক্যে নিজে বলেই গেলেন ধান ছালা দুই গেছে। এখন খাবো কি।
শুভাকাঙ্ক্ষীর কথা শুনে আমার মনে পড়ে গেলো দেশের কোনো কোনো স্থানে কৃষক বিতৃষ্ণ হয়ে ধান ক্ষেতে আগুন লাগিয়ে দিচ্ছেন। পত্রিকার প্রথম পাতার ছবিশুদ্ধ খবর ৪০০ টাকার ধান আনতে ৫০০ টাকা জোন খরচ। সব মিলয়ে আমি একটা জিনিস ভাবলাম। সরকার এতে এক ধরনের প্রশান্তি বোধ করতেই পারেন। বলতে পারবেন ধান চালের দাম কমে যাওয়ায় দরিদ্র শ্রেণির মানুষ খুব খুশী। একারণে তারা আগামী সংসদেও আমাদের কথা মনে রাখবেন। তবে আমার কাছে অন্য আরেকটি খবর আছে। কয়েক বছর আগে ধানের দাম আগের তুলনায় কমে গিয়েছিল। তখন মানুষকে বলতে শুনেছি, এই সরকারকে আর ভোট দেবো না। কারণ তারা কৃষককে ন্যায্য মূল্য দেয়নি। আমি জানি না এমন বাতিক এই সরকারের ওপর কোনো প্রভাব ফেলবে কিনা। তবে, আমরা যারা ধান চাল কিনে খাওয়া পার্টি তারা বেশ ভালোই আছি, এই কারণে যে চালের দাম নাগালের মধ্যে।
এতো গেল ধান নিয়ে কথা। এবার আসি আম নিয়ে। কৃষি বিভাগ ঢাক পিটিয়ে বলেছিল, এবার সাতক্ষীরা থেকে ২০০ মেট্রিক টন আম যাবে ইউরোপ। তবে কৃষকরা বলছেন, মধ্যস্বত্ত্বভোগী এনজিওগুলো আমাদের কাছ থেকে আম কিনে বিদেশে পাঠাবে বলে আমাদের অনেক পরিশ্রম করিয়েছে। আম বাগানে অতিরিক্ত পরিচর্যা করতে হয়েছে। নাওয়া খাওয়া বাদ দিয়ে শ্রোতাঙ্গদের খাদ্যবাঞ্ছা ও মনোবাঞ্ছা পূরণে বাংলাদেশের এনজিওগুরো ফড়িয়া হিসাবে সেসব দেশে আম পাঠাবে বলে ওয়াদা করায় আমরা শুধু খেটেই মরেছি। এখন শুনছি তারা কেউ কেউ আম নেবে না। সেই এনজিওগুলো আর ফোন ধরছে না। তারা দূরে বসে মজা দেখছে। আমচাষীরা এবারও গাছতলায় বসে আহাজারি করছে। আর বনের পাখিরা মনের সুখে পাকা আম খাচ্ছে। তবু জেনেছি বেশ কয়েক টন আম এরই মধ্যে ঢাকায় চলে গেছে। অচিরেই এ আম পাড়ি দেবে ইউরোপ পর্যন্ত। বলে রাখি গত বছরও কৃষি বিভাগ ঢোল পিটিয়ে বলেছিল ইউরোপ যাবে ২০০ টন আম। শেষ খবর হলো সেবার বিদেশে সাতক্ষীরার আম গেছে মাত্র ২৭ মেট্রিক টন। প্রতারিত আমচাষীরা বলেছিলেন, এবার মধ্যস্বত্ত্বভোগী ফড়িয়া এনজিওগুলো এখানে এলে সুদে আসলে আদায় করে ছাড়বো। অবশ্য তা কেবল মুখেই রয়ে গেছে। এ বছর কিন্তু কৃষকরা এ বিষয়ে এখনও কিছু বলেন নি। তবে তারা আমের দাম না পেয়ে এখন হতাশ।
খবরে প্রকাশ সোমবার সদর উপজেলার বলাডাঙ্গা গ্রামের হতভাগ্য বৃদ্ধ চাষী জয়নাল আবেদিন (৬৫) তার নিজ বাগানের আমরুপালি জাতের আম পাড়ছিলেন। এ খবর পেয়ে সেখানে কৃষি বিভাগের লোকজন এবং নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট পৌঁছে যান। তারা দেখতে পান জয়নাল আবেদিন কাঁচা অপরিপক্ক আমরুপালি পেড়ে ক্যারেট ভর্তি করছেন। ভ্রাম্যমাণ আদালতের বিচারক জয়নালকে তিনদিনের বিনাশ্রম কারাদণ্ড দেন। সাথে জরিমানা করেন ২০০ টাকা। অনাদায়ে কারাদণ্ড চারদিন বলে রায় দেন তিনি। রোজাদার বৃদ্ধ জয়নালের পরিবারের লোকজন কাকুতি মিনতি করে বলেছিল, ‘স্যার জেল দেবেন না। ইনি তো রোজা। তার ওপর বয়স হয়েছে অনেক। একটু মর্জি করুন’। কিন্তু একটা কথা আছে না হাকিম নড়ে তো হুকুম নড়ে না। এক্ষত্রেও তাই হয়েছে। বৃদ্ধ জয়নাল নিজ বাগানের কাঁচা আম পেড়ে দণ্ডনীয় অপরাধ করায় কারাগারে নিক্ষিপ্ত হলেন। বলা বাহুল্য এবার আমরুপালি জাতের আম পাড়ার প্রশাসনের নির্ধারিত দিন আগামী ৮ জুন। জয়নাল তার আগেই আম পেড়ে দণ্ডনীয় অপরাধ করেছেন। কারণ তিনি প্রশাসনের বেঁধে দেওয়া সময়কে গুরুত্ব না দিয়ে আম পেড়ে ফেলেছেন। ভাগ্যিস জয়নাল আবেদিন কারও আম চুরি করেন নি। নিজের আমেই এতো জ্বালা পরের আম চুরি করলে না জানি কি হতো। দণ্ড বোধ করি বেড়ে যেতো বহুগুন।
আমার কাছে আরও দুটি টাটকা খবর আছে। সেটা হলো সাতক্ষীরা সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ক্যাম্পাসে সেপটিক ট্যাংকের পাশে মাটি চাপা দেওয়া অবস্থায় পাওয়া গেছে বিপুল পরিমান সরকারি ওষুধ। কেউ বলছেন ১০ বস্তা। কেউ বলেন ১৫ বস্তা। এসব ওষুধের মেয়াদও নাকি ২০২২ সাল পর্যন্ত। যেদেশে চিকিৎসার অভাবে শত মানুষ মারা যায় সেদেশে মাটির তলে ওষুধের খনি পাওয়াটা কি ভাগ্যের ব্যাপার নয়। তবে কে কোন খায়েসে কেনো এই ওষুধ পুঁতে ফেলেছেন আমার বোধগম্য হয়নি। জড়িত যেই থাকুক তিনি কিন্তু এখনও নজরের বাইরে। বেচারা জয়নালের মতো ভাগ্য নয় তার। নিশ্চয়ই তিনি আরামে আয়েশে এসি লাগানো কক্ষে হিম বাতাস খাচ্ছেন। তিনি তো আর ধরা পড়েন নি। পড়বেনই বা কেনো। তিনি তো সৌভাগ্যের বরপুত্র।
খবরে প্রকাশ গত ২৪ মে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়ে গেলো। তবে এই খবরের পেছনের খবর হলো এই পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়ে গেছে। প্রশাসনের নজরে তা এসেছে। কলারোয়ার সোনলী সুপার মার্কেট ভবনের ওপরতলায় এদিন সকালে ফাঁস হওয়া প্রশ্ন মোবাইলে ধারণ করে ব্লাকবোর্ডে লিখে দেওয়া হচ্ছিল। আর সামনে উপবিষ্ট প্রশ্ন ক্রেতা সাধারণ তা লিখে নিচ্ছিলেন। জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা বিভাগের কর্মকর্তারা ও র্যাব সদস্যরা যৌথ অভিযান চালিয়ে এমন ২৯ জনকে হাতেনাতে ধরে ফেলেন। পরে তাদের মধ্যে ২১ জনকে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট দুই বছর করে কারাদণ্ড দেন ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে। এর মধ্যে পাঁচজন প্রশ্নফাঁসচক্রের সদস্য, ১৬ জন চাকুরিপ্রার্থী পরীক্ষার্থী ও ৮ জন অভিভাবক ছিল। তাদের কাছ থেকে মোটা অংকের টাকা আগেই হাতিয়ে নিয়েছিল ফাঁস চক্রটি। তবে ভাগ্যবান হলেন অভিভাবকরা। তারা নিঃশর্ত মুক্তি পেয়েছেন। তারপর আরেক দল ভাগ্যবান হচ্ছে তারাই যারা সরকারের সিন্দুকের তালা খুলে প্রশ্ন ফাঁস করে নগদ টাকায় বিক্রির পরও মাত্র দুই বছরের কারাদণ্ড পেয়েছে। আর সবচেয়ে ভাগ্যাহত হলেন সাত নারীসহ যে ১৬ জন তাদের অভিভাবকের কাছ থেকে টাকা নিয়ে প্রশ্ন কিনে চাকুরি পেয়ে বেকারত্ব ঘুচাতে চেয়েছিলেন। তাদেরও সাজা হলো দুই বছরের।
খবরে প্রকাশ কালিগঞ্জের বিষ্ণুপুরে জনৈক আবুল কালামের ছাগল প্রতিবেশি আজগর আলির পুইশাকের একটি ডগা খেয়ে ফেলেছিল। এতে রাগান্বিত হয়ে আজগর আলি ছাগলটিকে গ্রামের খোয়াড়ে ঢুকিয়ে দেন। আর এতেই ক্ষুব্ধ হন ছোট ভাই আক্কাজ আলি। বাড়ির উঠোনো এ নিয়ে শুরু হয় কুরুক্ষেত্র। শেষমেষ বড় ভাইয়ের ধারালো দায়ের কোপে প্রাণ হারান ছোট ভাই আক্কাজ আলি।
এতোসব দেখেশুনে আমার আর ভাল লাগছে না। তাই মনের সুখে একটি গান গেয়েই সুখের নীড় খুঁজি।
পাদটিকা।
একজন লোক যার বাস সাতক্ষীরাতে
বলে খুব সুখ নাকি এইখানে থাকাতে।
কমদামে ধান কিনি চাষীর পেটে লাথি মারি’
নাম মূল্যে আম কিনি ফড়িয়া হয়ে চালান করি।
কাঁচা আম পাড়লে পর তিনদিনের জেল দেই
আম চুরি করলে কিন্তু ফাঁসি ছাড়া রক্ষা নেই।
পরীক্ষার প্রশ্ন আউট দুই বছর জেলে থাকবা
ফের যদি প্রশ্ন আউটে টাকা নিয়ে পেট ভরো
পাঁজি পুঁথি দেখে তবে দুই সনের সাজা দেবো।
মাটির নিচে ওষুধ খনি, ফণী নয় বৃষ্টি এসে ভেজাল বাঁধালো
এবার এমন মাটি চাপা দেবো তদন্ত রিপোর্ট কবর দেবো
দুদক যেনো হাতড়ে শুধু ফিরে ফিরে যায়।
লেখক: সাতক্ষীরা করেসপন্ডেন্ট, দৈনিক যুগান্তর ও এনটিভি। (লেখকের একান্তই ব্যক্তিগত অভিমত, এর সাথে সম্পাদকীয় পলিসির কোন সম্পর্ক নেই)